ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫ , ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ |

নাজিম রুবেল-সমাজকর্মী ও কলামিস্ট

ক্ষমতার ভাগ চাও, কিন্তু দায় নয়?” – রাজনীতি কি শুধু সুবিধার জন্য?”

ভয়েস প্রতিদিন ডেস্ক
আপলোড সময় : ০৪-০৬-২০২৫ ০৪:০১:৫০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৪-০৬-২০২৫ ০৪:০১:৫০ অপরাহ্ন
ক্ষমতার ভাগ চাও, কিন্তু দায় নয়?” – রাজনীতি কি শুধু সুবিধার জন্য?”
নাজিম রুবেল-সমাজকর্মী ও কলামিস্ট(লন্ডন প্রবাসী) বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ক্ষমতা ভোগ একটি অলিখিত অধিকার, অথচ দায়িত্ব একটি অপছন্দনীয় বোঝা হয়ে উঠেছে। বারবার দেখা যাচ্ছে—কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হলে, তাঁর দল প্রথমেই দায় ঝেড়ে ফেলে এবং বলে, “এটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার, দল এর দায় নেবে না।” এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক দায়িত্বের পরিহার নয়, বরং একটি বিপজ্জনক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। কেননা, আমরা জানি—সেই রাজনৈতিক ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন দলের প্রতীকে, দলের নামে, দলের অর্থ ও জনশক্তি ব্যবহার করে। তিনি জনসমক্ষে পরিচিতি পেয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে। তাহলে তাঁর অপকর্ম দলীয় দায় থেকে কীভাবে মুক্ত হতে পারে? নৈতিক দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রাজনৈতিক দলের মূল পরিচয় জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার মধ্যেই নিহিত। Jean-Jacques Rousseau তাঁর Social Contract তত্ত্বে উল্লেখ করেছিলেন—“রাজনীতি মানে জনগণের সঙ্গে নৈতিক চুক্তি।” যদি সেই চুক্তির একপক্ষ জনগণ হয়, আর অন্যপক্ষ রাজনৈতিক দল—তবে দলীয় নেতার অপকর্মও সেই চুক্তিভঙ্গের পরিণতি। এমনকি আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও রাজনৈতিক দল কেবল একটি সংগঠন নয়, বরং তা একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। Harvard University-এর রাজনৈতিক তাত্ত্বিক Nancy Rosenblum বলেন, “Political parties do not just contest elections—they create moral expectations.” যে দল এই নৈতিক প্রত্যাশাকে অস্বীকার করে, তারা কেবল রাজনীতি নয়, গণতন্ত্রকেই হুমকির মুখে ফেলে। বাস্তব উদাহরণ: দায় এড়ানোর সংস্কৃতি আমরা প্রায়শই দেখি—কোনো নেতা ঘুষ গ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, জমি দখল, বা বিচারবহির্ভূত অপরাধে যুক্ত হলে—দল তার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায়, অথচ ওই একই দল নির্বাচনের সময় তাকে পোস্টার, ব্যানার, জনসভায় তুলে ধরেছিল নায়ক হিসেবে। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেই—২০২৩ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক শহরের মেয়র দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগে গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে ছিল কোটি টাকার সরকারি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ। অথচ তাঁর দল শুধু বললো, “এটা দলের কোনো সিদ্ধান্ত নয়, তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।” কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ব্যক্তি কি নিজে নিজে মেয়র হয়েছিলেন? নাকি দল তাঁকে মনোনয়ন, প্রচার ও জনসম্পৃক্ততা দিয়েছিল? একই ধারা দেখা যায় দেশের সব বড় দলেই। একেকজন মন্ত্রী বা সাংসদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চললেও, দল তাঁদের পাশে থাকে যতদিন না প্রচণ্ড চাপ আসে—যেটা স্পষ্টভাবে বোঝায়, দল দায় এড়াতে চায় যতক্ষণ না জনরোষে পড়ে। দায়বোধের অনুপস্থিতি: গণতন্ত্রের জন্য হুমকি এই সংস্কৃতি একটি গভীর বার্তা দেয়—রাজনীতি এখন আদর্শের নয়, স্বার্থের জায়গা; দায় নয়, সুবিধার মাঠ। এবং এর পরিণতি হচ্ছে ভয়ংকর। জনগণের আস্থা হারায়, যুবসমাজ রাজনীতিকে ঘৃণা করতে শুরু করে, প্রশাসন হয়ে পড়ে দলনির্ভর আর বিচারব্যবস্থা হয়ে যায় বিভ্রান্ত। John Locke, গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি নির্মাতা, বলেছিলেন—“Where there is no responsibility, there can be no legitimacy.” এই বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রে হুবহু মিলে যায়। জনগণের করণীয়: প্রশ্ন তুলতে হবে এখন সময় এসেছে, জনগণকেই প্রশ্ন তুলতে হবে— •আপনার দলীয় পরিচয়ে নেতা সুযোগ নেয়, কিন্তু বিপদে দল নেই—এটা কি গণতন্ত্র? •দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, দল কি শুধু চুপ করে থাকবে? •নেতার সুবিধা দল নেবে, আর ব্যর্থতায় দায় এড়াবে—এটা কি নৈতিক রাজনীতি? যদি আমরা এই প্রশ্নগুলো না তুলি, তাহলে আমরা নিজেরাই এই অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। রাজনীতি মানে দায়িত্ব: রাজনীতি মানে কেবল গদি নয়, প্রতিশ্রুতি; কেবল প্রতীক নয়, দায়িত্ব। যে রাজনীতিতে ব্যক্তির অপকর্মকে দল এড়িয়ে যায়, সেখানে আদর্শবোধের মৃত্যু হয়। জনগণের টাকায় গঠিত একটি রাষ্ট্রে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন প্রতিনিধির সব কাজই ব্যক্তিগত নয়, রাজনৈতিক—এবং দলীয়। আমরা আর শুনতে চাই না—“এটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়।” আমরা জানতে চাই—দল কী পদক্ষেপ নেবে? দল কতটা দায় নেবে? দল কাকে প্রতিনিধিত্ব করে—জনগণকে, নাকি অপরাধীকে? “যদি দল দায় না নেয়, তবে জনগণ একদিন দলকেই দায়ী করবে। আর তখন ইতিহাস কোনো পক্ষ নেয় না—শুধু বিচার করে।” নাজিম রুবেল, সমাজ কর্মী ও কলাম লেখক ( লন্ডন থেকে)

নিউজটি আপডেট করেছেন : SM Sohel

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ